" মিস্টার সেনের মেয়েটাকে দেখেছিস তো? সারাদিন রংচঙে অদ্ভুত জামাকাপড় পরা ছেলেগুলোর সাথে ঘুরে বেড়ায়! মাঝেমাঝে তো বাইকের পেছনে বসেও ঘুরে বেড়ায়! কি অসভ্য! মাগো, ছ্যাঃ!"
" দেখব না আবার! রোজই দেখছি, সঙ্গে মিস্টার ভাদুড়ী আর মিস্টার ব্যানার্জির মেয়েরাও তো থাকে!"
" মিস্টার স্যান্যালের ছেলেরাও থাকে, দেখিসনি? আরও কতগুলো ছেলেও থাকে... চিনি না, বোধহয় সি ব্লকের ছেলে ওরা।"
" তোরা ভাল করে জানিসই না, দেখছি। বি, ডি, সি আর এইচ ব্লকের প্রায় দশ বারোজনের দল ওরা। বিশাল বন্ধুত্ব ওদের মধ্যে।"
" হুঃ, বন্ধুত্ব না ছাই! ছেলে মেয়েতে আবার বন্ধুত্ব হয় নাকি? ঘি আর আগুন কখনও পাশাপাশি থাকতে দেখেছিস? নোংরামি করে বেড়ানোই কাজ ওদের। পার্টি, হইহুল্লোড় লেগেই থাকে। এই তো সেদিন, আমার মেয়ে এসে বলছিল..."
" ঘোরকলি! বুঝলি? এদের জন্যই সমাজটা উচ্ছন্নে যাচ্ছে।"
" ঠিক বলেছিস, ওদের বাবা মায়েদের মুখ দেখানোর জো নেই।"
" না রে, মিসেস স্যান্যালের যা ডাঁট! মনে হয় না, কোন লজ্জা নামক অনুভূতি রয়েছে!"
" সন্ধ্যে হয়ে এল, যাই রে..."
" দাঁড়া, আমিও তো যাব..."
" চল... চল..."
কথা হচ্ছিল 'সাঁঝের বাতি' আবাসন সমিতির বেশ কয়েকটি পরিবারের গিন্নিদের মজলিসে। সারাদিন সংসারের কাজের ফাঁকে এই বিকেলের জমায়েতটাই ওদের সকলের প্রাণশক্তির আধার। সবাই এবার যে যার নিজের ঘরের পথে।
এই মজলিসকে যথাসম্ভব এড়িয়ে চলে পরমা। ঐ তথাকথিত কুখ্যাত ছেলেমেয়েদের দলে তার মেয়ে সঞ্জনাও রয়েছে যে! ওদের চোখে পড়ার আগেই তাড়াতাড়ি পা চালিয়ে জায়গাটা পেরিয়ে এসেছে পরমা। মাথার মধ্যে রাগের পোকাগুলো কিলবিল করতে শুরু করে দিয়েছে।
বাড়িতে এসেই সে ফেটে পড়ে, " সঞ্জনা, সঞ্জনা... আমার তো মুখ দেখাবার আর জায়গা রইল না! বাড়ির বাইরে পা দিলেই তোর নামে চারটি বাজে কথা কানে আসে! একটু শান্তি দিতে পারিস না?"
" উফ্, মা! আবার কি হল? কি করলাম নতুন করে? আর তোমাকেও বলি, ঐ কানাকানি করা কাকিমাবৃন্দকে একটু কম গুরুত্ব দিতে পার না?" কান থেকে হেড ফোন খুলে নির্বিকার ভঙ্গিতে বলে সঞ্জনা।
" চুপ কর... এরপর যেদিকে দুচোখ যায়, সেদিকেই চলে যাব। আর পারছি না আমি!" গজগজ করতে করতে রান্নাঘরে যায় পরমা।
" আবার নতুন করে কি করলে দিদিভাই? মাকে খালি জ্বালাতন কর!" চিৎকার চেঁচামেচি শুনে হাজির হয়েছেন মনোরমাদেবী, সঞ্জনার ঠাম্মা।
" তুমি ঘরে চল ঠাম্মা, এসব ছোটখাটো বিষয়ে বড় বড় লোকেদের মাথা ঘামাতে নেই! তোমার সাথে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা আছে আমার!" মনোরমাদেবীকে প্রায় ঠেলেই তাঁর ঘরে নিয়ে যায় সঞ্জনা, " সামনেই তো স্বাধীনতাদিবস। আমাদের বন্ধুদের দলের সকলে ভাল কিছু করতে চাই এই বিশেষ দিনে।"
" বেশ তো, এ তো খুব ভাল কথা দিদিভাই। তুমি তো জানো, আমার শ্বশুরমশাই অর্থাৎ তোমার বড়দাদু একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী ছিলেন। ওনার স্ত্রী মানে তোমার বড়মা, সংসারে থেকেও স্বাধীনতা সংগ্রামীদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন।"
" আমি জানি ঠাম্মা, বড়দাদু দিনের পর দিন বাড়ির বাইরে থেকে অনেক কষ্ট করে স্বাধীনতার জন্য লড়েছিলেন। আর বড়মা একা হাতে ছেলেমেয়েদের মানুষ করেছিলেন। তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামীদের জন্য খাবার রান্না করে পাঠাতেন, সোয়েটার বুনে দিতেন, নিজের গয়নাও দিয়েছিলেন।"
" ঠিক বলেছ দিদিভাই, বৃটিশ পুলিশদের অকথ্য অত্যাচারে বড়দাদুর হাতের একখানা নোখও আস্ত ছিল না, চোখ খারাপ হয়ে গিয়েছিল।"
" কিন্তু এত কিছুর পরেও বড়দাদু স্বাধীন ভারতে কোন সম্মাননা পাননি। তিনি বলতেন, ভারতমাকে স্বাধীন করার লড়াইয়ে আমিও থাকার সৌভাগ্য অর্জন করেছি। ভারত মাকে স্বাধীন করতে পেরেছি, এটাই আমার স্বীকৃতি। এর বেশি আশা করাটা তো লোভ!"
" ঠিক বলেছ দিদিভাই, সেই মহান মানুষের পুত্রবধূ হতে পারার সৌভাগ্য হয়েছে আমার। সেই মানুষটার সান্নিধ্যে এসে ধন্য হয়েছে আমার জীবন।"
এরপর বেশ কিছুক্ষণ ঠাম্মা আর নাতনিতে স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষ্যে গভীর পরিকল্পনা চলতে থাকে।
" বাবা, স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষ্যে কিছু পরিকল্পনা করেছি বন্ধুরা মিলে। চাঁদা চাই।" সঞ্জনার কথায় প্রশ্রয়ের হাসি হাসে তার বাবা রথীন্দ্র।
" তোমার জন্যই মেয়েটা গোল্লায় যাচ্ছে।" রাগ করে পরমা।
" পরমা, আমার মেয়ের প্রতি আমার পূর্ণ বিশ্বাস আছে। ছেলেদের সাথে মিশলেই মেয়ে খারাপ- এই তত্ত্বের ঘোরতর বিরোধী আমি। নির্মল বন্ধুত্ব ওদের মধ্যে... এভাবে ভুল বুঝে দূরে সরিয়ে দিও না ওকে।"
" হ্যাঁ বৌমা, যারা অনর্থক সমালোচনা করছে, তাদের ঘরের ছেলেমেয়েরা কি কি করছে, সেসব খবর কিন্তু আমার কাছে আছে। আমার দিদিভাই কোন ভুল কাজ করতেই পারে না।" শাশুড়িমা ও স্বামীর কথায় নিশ্চিন্ত হতে চেষ্টা করে পরমা।
নিজের সন্তানকে কে ই বা অবিশ্বাস করতে চায়! কিন্তু চারজনের পাঁচটি বাজে কথা মনকে প্রভাবিত করে বৈকি!
" তোমাদের ভরসার সম্মান রাখি আমি, আর আজীবণ রেখে চলব।" মায়ের গলা জড়িয়ে বলে সঞ্জনা।
" ঐ ছেলেমেয়েদের দলটা তো চাঁদা চাইতে বেরিয়েছে রে। স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষ্যে কিসব করবে! আদিখ্যেতা দেখে বাঁচি না বাবা!"
" আমি তো মুখের উপর বারণ করে দিয়েছি, টাকা কি গাছে ফলে নাকি!"
" আমার তো স্বাধীনতা দিবসে পার্টি রয়েছে। দশ হাজার দিয়ে শাড়ি কিনলাম।"
" আমিও কিনলাম, কুড়ি হাজার পড়ল।"
গিন্নিদের মজলিস টাকার গরমে আরও গরম হয়ে উঠল।
আবাসনের কিছু পরিবার ছাড়া সিংহভাগই চাঁদা দিতে অস্বীকার করায় সঞ্জনারা নিজেদের পরিবার থেকেই চাঁদা জোগাড় করল। আবাসনের সকলকে নেমন্তন্নও করে এল ওরা। না জানি কি মজার ব্যাপার হবে- কৌতুহলী আবাসনবাসীরা স্বাধীনতা দিবসে হাজির হল মঞ্চের সামনে। প্রথমেই ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা নাচ গান পরিবেশন করল। তাদের দলে ছিল আবাসনে কর্মরত গরিব মানুষগুলোর ছেলেমেয়েরাও। এরপর শুরু হল রক্তদান কর্মসূচি। সঞ্জনা ও তার বন্ধুরা তো বটেই, তাদের বাবা মায়েরাও স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করল। উৎসাহিত হয়ে আবাসনের আরও অনেকেই সামিল হলেন এই মহান যজ্ঞে। গিন্নিদের মজলিসের কেউই এগিয়ে এল না। তাদের তথাকথিত ভাল ছেলেমেয়েরাও ব্রাত্যই রয়ে গেল। পাশের বস্তির গরিব মানুষগুলোর হাতে তুলে দেওয়া হল বেশ কিছু অর্থ।
" দেখলে তো পরমা, আমাদের মেয়ে আমাদের কতটা গর্বিত করল! অল্পবয়সী ছেলেমেয়েরা হুল্লোড় তো করবেই, কিন্তু সাথে কতটা দায়িত্ববোধের পরিচয় আজ দিল!" রথীন্দ্রের কথায় কিছুই বলতে পারে না পরমা।
তার দুচোখে তখন জলের ধারা, আনন্দে গর্বে বুক ভরে উঠেছে! মিটিমিটি তৃপ্তির হাসি হাসছেন মনোরমাদেবী, তিনি তো আগে থেকেই সব জানতেন।
